নিষিদ্ধ হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এ নিয়ে ১৯৪১ সালে গঠিত এ ধর্মভিত্তিক দলটি তৃতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হলো। জামায়াতসহ বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১০টি রাজনৈতিক দল নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে।
এ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এই আইনের তফসিল-২-এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো।
এর আগে নিষিদ্ধ যারা
এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে ৯টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব সংগঠন বাংলাদেশে কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত নিষিদ্ধ এই সংগঠনগুলো হলো- শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
নিষিদ্ধ সংগঠনের মধ্যে ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চারদলীয় জোট সরকার প্রথমে শাহাদাত-ই-আল হিকমা নামে জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। এরপর ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশকে (জেএমজেবি) এবং ওই বছরের ১৭ অক্টোবর হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীকে বাংলাদেশে (হুজিবি) নিষিদ্ধ করা হয়। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। চারদলীয় জোট সরকারের সময় নিষিদ্ধ এসব জঙ্গি সংগঠনের কয়েকটিকে তৎকালীন সরকারের এমপি মন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ছয় সংগঠন
জামায়াত ইসলামীসহ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা সামনে আসে। পরে ২০১৫ সালের ২২ মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করে। একের পর এক জঙ্গি হামলা ও হত্যার প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আল্লাহর দল নামের জঙ্গি সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে এই সংগঠন জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে জেএমবির বোমা হামলায়ও আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়। জেএমবি নিষিদ্ধ হলে আল্লাহর দল আবার সক্রিয় হয় আমিন মতিন মেহেদীর নেতৃত্বে। ২০১৪ সালে আল্লাহর দলের নাম পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর সরকার’ রাখা হয়। কয়েক বছর দলটির দৃশ্যমান কোনও তৎপরতা না থকলেও নিষিদ্ধ জেএমবির সহযোগিতায় ২০১৯ সালে ‘আল্লাহর দল’ সারা দেশে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার তথ্য আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ওই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ ৮ জন সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল্লাহর দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২০২৩ সালের ৯ আগস্ট নিষিদ্ধ করা হয় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে’। এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে এ মর্মে প্রতীয়মান হয় যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক জঙ্গি দল/সংগঠনটির ঘোষিত কার্যক্রম দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা পরিপন্থি। ইতোমধ্যে দল/সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
উল্লেখ্য, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। একই বছরের ৭ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঘুণে ধরা সমাজকে বাঁচাতে সব দল নিষিদ্ধ করে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে বাকশাল গঠন করেন। বাকশালকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সামরিক বেসামরিক আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাকশালের অন্তর্ভুক্তির আইনগত সুযোগ ছিল। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমান বলে আবারও বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে আওয়ামী লীগসহ পুরনো দলগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ তৈরি হয়।
জামায়াতের রাজনীতির ইতিহাস
আব্বাস আলী খান রচিত ‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস’ বই থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গঠন হয়। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যান।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত ইসলামী একবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই সময় মওদুদী ও গোলাম আজমসহ দলটির অন্তত ৬০ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ওই বছরের অক্টোবরেই আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
জামায়াত ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাকিস্তান ভাঙার জোরালো বিরোধিতা করেছিল। দলটির সদস্যরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ডা. আব্দুল মালিককে গভর্নর একটি প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের উদ্যোগে গঠিত এ প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভায় আব্বাস আলী খানকে (পরবর্তীকালে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির) শিক্ষামন্ত্রী করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মুজিবনগর সরকার জামায়াত ইসলামীসহ ৬টি দলকে নিষিদ্ধ করে। এর ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের কারণে সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধই থেকে যায়। তখন গোলাম আজমসহ জামায়াতের কিছু নেতা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। এ সময় আবার রাজনীতির ময়দানে ফেরে জামায়াত। ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে একটি জোটের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত হয়।
পরে পাকিস্তান থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। এসময় এর ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয় আব্বাস আলী খানকে। এরপর থেকে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনীতি করে যাচ্ছে দলটি।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করে। এ ছয়টি সংসদেই দলটির কম বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। এতে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী ও মহাসচিব আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ পর্যায়ের চার নেতার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দলের আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এক রিটের পর ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।
ওই রায়ের পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এদিকে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত ইসলামী আপিল করলে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর এক আদেশে ওই আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।