মেহেরপুর সরকারি শিশু পরিবার (বালক) ডরমেটরি ভবনের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অন্যের লাইসেন্সে কাজ করেছেন বড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খোকন।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ও বর্তমানে সহকারী পরিচালক কাজী কাদের মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সাথে আতাত করে সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন তিনি। এছাড়াও গণপূর্তের উপসহকারি প্রকৌশলী ইমরান হোসেনের যোগসাজসে সংস্কার কাজের এস্টিমেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। তবে উপসহকারি প্রকৌশলী ও সমাজসেবা একে অপরের উপর দায় চাপিয়েছেন।
জানা গেছে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সরকারি মেহেরপুর সরকারি শিশু পরিবার (বালক) ডরমেটরি ভবন সংস্কার কাজের মুল ঠিকাদার অঞ্চল ভট্টাচার্যের লাইসেন্সে হচ্ছে। তবে সাবেক মন্ত্রীর প্রভাবে কাজী কাদের মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মাধ্যমে খোকন কাজটি করেন। সংস্কার কজের মধ্যে ছিলো জানালায় থাই গ্লাস স্থাপনসহ টয়লেট মেরামত বাবদ ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ১৯ টাকা, ডরমিটরি ভবনের ডাইনিং ও প্রার্থনা কক্ষ মেরামত বাবদ ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ২৭৪ টাকা, স্টোর রুম ও রান্নাঘরের মেরামত বাবদ ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ২১৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী সরকারি মেহেরপুর সরকারি শিশু পরিবার (বালক) ডরমেটরি ভবনের জানালায় থাই গ্লাস স্থাপনসহ টয়লেট মেরামতে প্লাস্টার, হোমোজিনিয়াস ফ্লোর টাইলস স্থাপন, ওয়াল টাইলস, ভিতরে প্লাস্টিক পেইন্ট, বাহিরে ওয়েদারকোট, ১৩টি জানালায় নতুন থাই এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন, মেহগনি কাঠের নতুন ২টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা, ৫টি বিব কর্ক, ২টি সাওয়ার হেড, ৮টি এক্সজস্ট ফ্যান, ৮টি টিউবলাইট।
ডরমিটরি ভবনের ডাইনিং ও প্রার্থনা কক্ষে মিরর পলিশড ফ্লোর টাইলস স্থাপন, ভিতরে প্লাস্টিক পেইন্ট, বাহিরে ওয়েদারকোট, ১২টি জানালায় নতুন থাই এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন, ১০টি জানালায় নতুন গ্রীল, মেহগনি কাঠের নতুন ৩টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা কাজ বাবদ ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ২৭৪ টাকা এবং ডরমিটরি ভবনের স্টোররুম ও রান্নাঘরে মিরর পলিশড ফ্লোর টাইলস, রান্নাঘরে হোমোজিনিয়াস ফ্লোর টাইলস, ওয়াল টাইলস স্থাপন, ওয়েদারকোট, ২টি জানালায় নতুন থাই এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন, ১৫টি জানালায় নতুন গ্রীল, মেহগনি কাঠের নতুন ২টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা, ১৮-মিমি পুরু বার্মাটিক বোর্ডের কেবিনেট, ১-অশ^শক্তি ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন পাম্প মটর স্থাপন কাজ বাবদ ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ২১৩ টাকা বরাদ্দ ও মঞ্জুরী প্রদান করা হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, শিশু পরিবার (বালক) চার তলা বিশিষ্ট একটি ডরমেটরি ভবন। কার্যাদেশে অনুযায়ী ডরমেটরি ভবনের জানালায় থাই গ্লাস স্থাপনসহ টয়লেট মেরামতের কথা উল্লেখ থাকলেও শুধুমাত্র ভবনের চারতলার টয়লেট মেরামত করা হয়েছে। টয়লেটের ভিতরে প্লাস্টিক পেইন্ট, বাহিরে ওয়েদারকোট দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ডিসটেম্পার। ১৩টি জানালার কথা উল্লেখ থাকলেও জানালা পাওয়া যায়নি তবে বারান্দায় ৮টি থাই এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন করা হয়েছে। মেহগনি কাঠের নতুন ২টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা দেওয়ার কথা থাকলেও দরজার দেখা মেলেনি। ২টি সাওয়ারহেডের একটিও দেওয়া হয়নি। ৮টি এক্সজস্ট ফ্যান এবং ৮টি টিউবলাইটের মধ্যে দেওয়া হয়েছে ১টি ফ্যান ও ১টি লাইট।
ডরমিটরি ভবনের ডাইনিং ও প্রার্থনা কক্ষ মেরামতে মিরর পলিশড ফ্লোর টাইলস স্থাপনের জায়গায় অনিয়ম কওে দেওয়া হয়েছে হোমোজিনিয়াস। ফ্লোর না ভেঙ্গেই টাইলস বসানো হয়েছে। ভিতরে প্লাস্টিক পেইন্ট ও বাহিরে ওয়েদারকোট দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ডিসটেম্পার। ১২টি জানালায় নতুন থাই এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন জায়গায় ৬টিতে ফ্রেম ও গ্লাস স্থাপন করা হয়েছে, ১০টি জানালায় নতুন গ্রীল লাগানোর কথা থাকলেও ৬টিতে নতুন গ্রীল লাগানো হয়েছে। মেহগনি কাঠের নতুন ৩টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা লাগানো হলেও দরজা ও পাল্লা মেহগনি কাঠের না বলে একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।
স্টোররুম ও রান্নাঘরের মেরামতে ওয়েদারকোট দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। ১৫টি জানালায় নতুন গ্রীলের কথা উল্লেখ থাকলেও সেখানে জানালা আছে ৫টি। মেহগনি কাঠের নতুন ২টি দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা দেওয়ার কথা থাকলেও ১টি দেওয়া হয়েছে, ১৮-মিমি পুরু বার্মাটিক বোর্ডের কেবিনেট জায়গায় দেওয়া হয়েছে নিন্মমানের পারটেক্স কেবিনেট।
এবিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক অঞ্চল ভট্টাচার্য জানান, আমার লাইসেন্সে কাজ করছে খোকন। কাজ যেহেতু খোকন করেছে তাই খোকন যাকে টাকা দিতে বলেছে আমি তার হাতে দিয়ে দিয়েছি। যেহেতু আমি কাজ করিও নি, তাই জানিও না। কাজে কোন অনিয়ম থাকলে যে কাজ করছে সেটা তাদের ব্যাপার।
এবিষয়ে আমিনুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এবিষয়ে সমাজসেবার সহকারি পরিচালক কাজী কাদের মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী বলেন, আমরা এই কাজের গুণগত মান ও এস্টিমেটে যা বলা আছে সে অনুযায়ী কাজ না হলে যে বিল বাকী আছে তা ছাড় করব না।
সমাজসেবার উপপরিচালক আশাদুল ইসলাম বলেন, যে কাজগুলোতে অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো যৌক্তিক। আমি উপলব্ধি করতে পারছি এস্টিমেটে এদিক-সেদিক করা হয়েছে। যেহেতু আমি এখানে আসার পর কাজটি পেয়েছি সেহেতু যেখানে কাজের যে সমস্যা আছে তা ঠিক না করলে কোন ছাড় নেই। অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঠিকাদারের কাছে শতভাগ কাজ বুঝে নেওয়া হবে। আমার সুযোগ আছে কাজটি বুঝে নেওয়ার। না হলে ওই শিশুদের কাছে আমি দায়ী হয়ে থাকব।
উল্লেখ্য: বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সাথে সখ্যতা গড়ে করেছেন একক রাজত্ব। সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও তার অনুসারীদের নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দুর্নীতি আর অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন তিনি। এর আগেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়। একের পর এক দুর্নীতি করলেও প্রভাব খাটিয়ে তিনি থাকছেন ধরা ছোয়ার বাইরে ও বহাল তবিয়তে।