আজ ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তার বিচার সম্পন্ন হয়ে ফাঁসির আদেশও হয়েছিল। কিন্তু বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায়, শেষ মুহূর্তে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে আটকে পড়া পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের কথা ভেবে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হন ভুট্টো। বিজয়ের পরের মাসে জানুয়ারির ১০ তারিখ পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে দিল্লিতে যাত্রাবিরতির মধ্য দিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর আটক হওয়া, আটক অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পুরো সময় তাঁকে দেখেছেন ও পরবর্তীকালে লিখেছেন এমন লেখকের বই ও সরাসরি কথা বলে কিছু তথ্য জানা যায়।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। তাঁর দেশে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে তাঁকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে একটি উড়োজাহাজ যাত্রা করে লন্ডনে। ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন দেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ফেরার পথে ভারতে যাত্রাবিরতি দিয়ে অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে পৌঁছান বাংলার এই নেতা।
১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যখন নামেন তিনি— তার আগে দেশ, দেশের মানুষের ৯ মাসের লড়াই নিয়ে তেমন তথ্য ছিল না তাঁর কাছে। বিজয়ী জনসমুদ্রের মধ্য দিয়ে তিনি সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কী ঘটেছিল সেই ৯ মাস। ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গকে বঙ্গবন্ধু একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেন তার বন্দিজীবনের বৃত্তান্ত। বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে শ্যানবার্গ লেখেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করে। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিদায় জানাতে তাঁকে কয়েক মুহূর্তের অনুমতি দেওয়া হয়। তাকে শুরুর কয়দিন ঢাকায় জাতীয় পরিষদ ভবনে ও সামরিক ছাউনির কোনও একটি স্কুলের নোংরা ও অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছিল।
তাঁর বিরুদ্ধে চালানো হয় প্রসহনের বিচার। পাকিস্তান সামরিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। ১২টি অভিযোগের ছয়টির দণ্ড ছিল মৃত্যু এবং অভিযোগগুলোর একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, বিচার শেষ হয় যেদিন সেই ৪ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। সে কারণেই রায় বাস্তবায়ন হলো কিনা, সে নিয়ে কোনও তথ্য নিশ্চিত করা যায়নি।
১৫ ডিসেম্বরের পর বঙ্গবন্ধুকে কয়েক মাইল দূরে এক অজ্ঞাত স্থানে কয়েক দিনের জন্য সরিয়ে নেন জেল সুপার। সেখানে ৯ দিন রাখার পরে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে শ্যানবার্গ বলেন, ভুট্টোর মনে হয়েছিল-মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করা হতে পারে। শেষ সময়ের নেগোসিয়েশনে ভুট্টো তাঁকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোনও রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিজয়ের এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সেদিন ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। ৭ জানুয়ারি তৃতীয় ও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধুকে রাজি করাতে না পেরে তাকে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হন তিনি। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়োজাহাজটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’
লন্ডন-নয়াদিল্লি-ঢাকা
লন্ডনে অবতরণের পরপরই ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু তখনও জানেন না দেশে কত কী ঘটে গেছে। স্বজনদের সঙ্গে তখনও কথা হয়নি। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রথম তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি।’ ৯ জানুয়ারি সকালে লন্ডনে বসেই টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করেন, ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন তিনি।
ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে গত কয়েক বছরে একাধিকবার কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি স্মৃতি থেকে খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে জানান। শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী বিমানে করে তিনি রওনা হতে বিমানবন্দরে পৌঁছালে প্রথম যে কথাটি শেখ মুজিব বলেন, ‘ব্যানার্জি, এখানেও আছেন!’ এরপর সারা পথের নানা স্মৃতির কথা তিনি নানা সময়ে বলেছেন। তিনি বলেন, উনি (শেখ মুজিব) তখন খুব এক্সাইটেড। উনি তখনও জানেন না কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়ে গেছে দেশে। কিন্তু তাঁর দুচোখে কেবলই নতুন দেশের স্বপ্ন। ঘর পরিবার কেমন আছে, গিয়ে সহযোদ্ধাদের কেমন দেখবেন—সেসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু এর মধ্যেই ওই যাত্রাপথেই তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি চাই ছয় মাস না, তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের ভারতে ফেরত নেওয়া হোক।’
দিল্লিতে প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেখান থেকে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। শশাঙ্ক জানান, উনি দ্বিতীয় যে ইচ্ছেটা প্রকাশ করেছিলেন তা হলো- ‘অবতরণের আগে কমেট বিমানটি বিমানবন্দরের ওপর কিছুক্ষণ চক্রাকারে যেন ঘুরে। ৪৫ মিনিট বিমান ঘোরানো হয়, বঙ্গবন্ধু নয়ন মেলে প্রথমবারের মতো দেখেন স্বাধীন বাংলাদেশ।’