মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৬:৪৫ পূর্বাহ্ন

মেহেরপুরে আঙুর চাষে সফল শরিফুল-মিম দম্পত্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক:
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
  • ১১ Time View
মেহেরপুরে আঙুর চাষে সফল শরিফুল-মিম দম্পত্তি

সমাজের অন্যান্য মানুষের মতো দুই হাত দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারেন না শরিফুল ইসলাম। ছোটবেলায় গ্রাম্য ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় ১০ বছর বয়সে হারাতে হয় এক হাত। পরিবারে বোঝা হয়ে থাকতে চাননি তিনি। নিজের আদম্য শক্তিতে শারীরিকভবে প্রতিবন্ধী হয়েও হার মানেননি তিনি।

একের পর এক চেষ্টা করেছেন নিজেকে স্বনির্ভর করার জন্য। এবার সেই স্বপ্ন তার পূরণের পথে। নিজেকে স্বনির্ভর করতে তার স্ত্রী শারমিন আক্তার মিমকে সাথে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় আঙুর ফলের চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই দম্পত্তি।

এই দম্পত্তির বাড়িতে বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ রঙের রাশিয়ান মিষ্টি জাতের গোল আঙুর। এসব ফল দৃষ্টি কাড়ছে এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীদের। আঙুরের থোকায় কৃষি উদ্যোক্তা শরিফুল ও মিম দম্পত্তির চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন।

বলছিলাম মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা শারিরীক প্রতিবন্ধী শরিফুল ও মিম দম্পত্তির কথা। মেহেরপুর জেলায় তিনি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম তার বাড়ির আঙ্গিনায় ৬ কাঠা জমির ওপর আঙুর চাষ করে সফল হয়েছেন।

জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও মাটির বৈশিষ্ট না জেনেই শুধুমাত্র ইউটিউব দেখে আঙুর চাষে আগ্রহী হন এই দম্পত্তি। প্রথমে গাছ সংগ্রহ করে ইউটিউব দেখে নিয়মকানুন জেনে বাড়ির আঙ্গিনায় ৬কাঠা জমিতে শুরু করেন চাষাবাদ। এসময় পরিবার ও আশপাশের অনেকেই তাদের নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে তারা থেমে যাননি। প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক চাষে গাছ থেকেই পেয়েছেন পর্যাপ্ত ফল ও মিষ্টি আঙুর। এখন শরিফুলের সংগ্রহে থাকা ৩টি জাতের পাশাপাশি ভারতের থেকে আরও কয়েকটি জাত সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সরেজমিনে শরিফুল ও মিম দম্পত্তির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বসতবাড়িতে ঢোকার প্রধান ফটকেই আঙুর গাছের মাচা। মাচাটি তিনি বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছেন। মাচার দিকে তাকালেই চোখে পড়ে প্রতিটি গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর ফল। এই দম্পত্তি তার আঙুর গাছের পরিচর্যা করছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা তার আঙুর গাছ দেখতে আসছে।

কৃষি উদ্যোক্তা শরিফুল বলেন, আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে বাম হাতে আঘাত লাগে। স্থানীয় এক গ্রাম্য চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় পরবর্তীতে একটি হাত কেটে ফেলতে হয়। যে কারণে আমি ভারি কোন কাজ করতে পারি না। একটি হাত না থাকার কারণে অনেকে কাজেও নেন না। ছোট একটা ব্যবসা ছিলো তাতেও কোন ফল হয়নি। অভাবের সংসারে বসে না থেকে নিজে কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। প্রায় দুই বছর আগে এক ছোট ভাই একটি আঙ্গুরের চারা এনে দেয় বাড়িতে রোপনের জন্য। সেই গাছে পর্যাপ্ত ফল আসে এবং ফল অত্যান্ত মিষ্টি হয়। সেই থেকে আমার ইচ্ছা ছিল মিষ্টি আঙুর চাষ করার। তখন ইউটিউবে অস্ট্রেলিয়ার একটি আঙুরের একটি ভিডিও দেখেছিলাম। তখন থেকে মিষ্টি আঙুরের চারা খুঁজতে থাকি। গত দেড় বছর আগে আমার ওই ভাইয়ের মাধ্যমে ভারতে যোগাযোগ করে সেখান থেকে ৮টি চারা নিয়ে এসে বাড়িতে লাগাই। চারা লাগানোর ৭ মাসে আমি ফলন পাই। ওই গাছে পর্যাপ্ত আঙুর ধরেছিল এবং ফল খুব মিষ্টি ছিল। তখন আমি চিন্তা করি এর প্রসার বাড়ানোর এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার।

ইতোমধ্যে আমি ৬ কাঠা জমি আঙ্গুর চাষ করেছি। ভারত থেকে আরও অন্যান্য জাতের চারার অর্ডার দিয়েছি। আমার এখানে ৩টি জাতের মোট ৩৪টি গাছ রয়েছে। ২২ হাজার টাকা ব্যয় করে বর্তমানে যে পরিমাণ ফল গাছে আছে সবকিছু ঠিক থাকলে আল্লাহর রহমতে ১৫-২০মণ ফল বিক্রি হবে। যা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয়ের সম্ভবনা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারই সফল হয়েছি। আমার আঙুর অত্যন্ত মিষ্টি। ইতোমধ্যে আমি গাছ থেকে চারাও তৈরী করছি। আমি কখনো আমার আঙুর গাছে ওষুধ কিংবা কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। বিষমুক্ত ফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেব এটাই আমার ইচ্ছা। বাংলাদেশের মাটি আঙুর চাষের উপযোগী। তাই সবাই তার বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করুক যাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এটা আমদানি করতে না হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে, নিজ দেশের আঙুর চাষের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদাও মিটবে। যে কোনো মাটিতে ৫০ শতাংশ জৈব সার দিয়ে মাটি প্রস্তুত করে আঙুর ফল চাষ করা যায়। এটা লতা জাতীয় গাছ, অল্প খাবারে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পরিচর্যা খুবই সহজ। একটি গাছ রোপণের পর প্রায় ৫০ বছর ফলন দেয়। প্রতি মৌসুমে একটি গাছে দেড় থেকে দুই মণ বা তারও বেশি ফলন হয়। একটি গাছে বছরে ২ বার আঙুর ধরে। সহযোগিতা পেলে এই চাষ তিনি আরও প্রসারিত করতে পারবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন।

শরিফুলের স্ত্রী শারমিন আক্তার মিম বলেন, দেশের মাটিতে অনেক ফল চাষ হতে দেখে আঙুরও চাষ হতে পারে এটা মাথায় আসে। আমরা ইউটিউব দেখে আঙুরের পরীক্ষামূলক চাষ করে সফল হয়েছি। একটা সময় আমরা এমন একটা দিনের ভিতর দিয়ে পার করেছি যা বলে বোঝানো যাবে না। অভাবের সংসারে নিজেরা কিছু করার চিন্তা সবসমই মাথায় ঘুরপাক খায়। আমার বাচ্চা যখন ছোট তখন আঙুর কি জিনিস সে চিনতো না। কারো হাতে দেখলে বলতো মা এটা কি। সেই কষ্ট নিয়েই এই চাষ শুরু করেছি। এখন আমাদের একটি আঙুর বাগান হয়েছে। আমার স্বামী একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। একটি হাত না থাকার কারণে তিনি কোন কাজ করতে পারে না। দুজনে কিছু করার চিন্তা নিয়েই এই চাষ শুরু করি। আল্লাহর রহমতে এবার প্রচুর ফলন হয়েছে । আশা করি আমরা এবার সফল হবো।

শরিফুলের বন্ধু রাশেদ ও প্রতিবেশী জাহিদ বলেন, আমরা জানতাম আঙুর বিদেশি ফল। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতেই আঙুর চাষ হচ্ছে। এই আঙুরটি বাজারের আঙুর থেকেও বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে দেখছে, আঙুর ফল খেয়ে সুনাম করছে। আমরাও শরিফুলের দেখাদেখি আঙুর ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, শিবপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম পরীক্ষামূলকভাবে তার বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করেছে। সব দিক বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে মেহেরপুরের মাটি ও আবহাওয়া আঙুর চাষের জন্য উপযুক্ত। শরিফুলের উৎপাদিত আঙুর স্বাদে খুব মিষ্টি। এলাকার লোকজন তার বাগান দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। আশা করছি শরিফুলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আশপাশের যারা বেকার যুবক রয়েছেন তারা আঙুর চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 onenewsbd24.com
Developed by: FAZLY RABBY
Tuhin