পলেথিন দিয়ে তৈরি করেছেন ঘর আর সেই ঘরেই মেয়ে এবং তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন তফুরা বেগম। পলিথিনের এই ঘরটি মাঠের মাঝখানে হওয়ায় নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। নেই টিউবওয়েল। চরম অভাব অনটনে চলছে তফুরার সংসার। কখনও কখনও না খেয়েও দিন পার করতে হয় তাদের।
হতভাগা তফুরা বেগমের বসবাস পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী ইউনিয়নের জেমজুট মুসলিমবাগ এলাকায়।
তফুরার স্বামী সৈয়দ আলীর বাড়ি পঞ্চগড় পৌর শহরের তেলিপাড়া এলাকায়। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। সৈয়দ আলী তফুরাকে বিয়ে করার পর আরও দুটি বিয়ে করেন। এরপর তাদের সংসারে শুরু হয় অশান্তি। ২০০৬ সালে তফুরা মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন জেমজুট এলাকায়। সেখানে বাড়িভাড়া নিয়ে মেয়েকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন। কয়েক বছর পর মেয়ে শরিফা খাতুনকে ফুলতলা এলাকায় বিয়ে দেন। সেখানে তার ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সংসার বেশিদিন টেকেনি। পরে পঞ্চগড়ে সাকোয়া এলাকায় আরেকটি বিয়ে করেন শরিফা। সেই সংসারে আরেকটি মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সন্তান জন্মগ্রহণ করার কিছুদিন পরে তার ২য় স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই শরিফা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
পরে তফুরা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে ও তিন নাতি নাতনিকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালান। এদিকে মেয়ে মানসিকভাবে বেশি অসুস্থ হওয়ার কারণে অন্যান্য ভাড়াটিয়া মানুষদের কাপড়সহ বিভিন্ন জিনিস পত্র নষ্ট করতে থাকে। তখন সবাই বিরক্ত হয়ে তাদেরকে ভাড়া বাসা থেকে বের করে দেয়। কোথাও কোনো থাকার জায়গা না থাকায় স্থানীয়রা পলিথিন দিয়ে একটি তাবু তৈরি করে দেয়। বর্তমানে সেই তাবুতে তিন মাস ধরে বসবাস করছেন তারা।
তফুরা বেগমের নাতি নয়ন ইসলাম বলেন, আমার নানি ভিক্ষা করে সংসার চালায়। এই ঘরটা এলাকার লোকজন টাকা তুলে তৈরি করে দিয়েছে। এখানে আমরা ৫ জন বসবাস করি। এখানে থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হয়।
পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস তফুরার
তফুরা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি। কয়েকমাস ধরে তার মাথায় সমস্যা হওয়ায় অন্য ভাড়াটিয়া মানুষদের কাপড়সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট করছে তাই তারা ভাড়া বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে না। এলাকার মানুষজন পলিথিন দিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানে কোন টিউবওয়েল নাই, কষ্ট করে দূর থেকে পানি নিয়ে আসে গোসল করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও আমরা কোন সহযোগিতাও পাইনা। এই ঘরে গরমের সময় প্রচণ্ড গরম করে আর বৃষ্টির সময় ছোট বাচ্চারা খুব ভয় পায়।
স্থানীয় বাবুল ইসলাম বলেন, এরা খুব গরিব মানুষ। অনেকদিন ধরে এই এলাকায় আছে। আগে জুটমিলে কাজ করে খাইতো। হঠাৎ করে এই মেয়েটা পাগল হয়। পাগল হয়ে যাওয়ার পর ভাড়াও কেউ রাখেনা। পরে আমরা এলাকাবাসী হাট বাজারে টাকা তুলে প্লাস্টিক দিয়ে এই ঘরটি করে দিয়েছি। সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন এদের জন্য যে কোন জায়গায় হোক ছোটখাটো একটা ঘর যেন করে দেওয়া হয়।
স্থানীয় আসাদুল্লাহ দুলু নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও তাদেরকে এই ঘরের মধ্যে থাকতে হয়। তাদের কোন টিউবওয়েল নেই। তারা বাড়ির পাশে অবস্থিত সমিলের টিউবওয়েল এর পানি ব্যবহার করে।
ইউপি সদস্য উসমান গণি বলেন, তারা এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন কিছু পাচ্ছে না। সরকার থেকে যা আসে সেটা আমরা ধাপে ধাপে সবার মাঝে বিতরণ করছি।
ময়দানদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার বলেন, তাদের বিষয়ে আমার জানা নাই, মেম্বার বলতে পারবে। তারা যদি এই ইউনিয়নের বাসিন্দা হয়ে থাকে তাহলে তো অবশ্যই সহযোগিতা পাবে। এখনতো কোন কিছু দিতে হলে জাতীয় পরিচয় পত্র লাগে।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার তৌকির আহমেদ বলেন, ওই নারী যদি বিধবা হয় এবং তার মেয়ে মানসিক প্রতিবন্ধীর হয় সেক্ষেত্রে আবেদন করেলে আমরা ভাতার ব্যবস্থা করে দিবো।
এ বিষয়ে বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার নজির বলেন, ময়দানদিঘী ইউনিয়নের অসহায় বিধবা নারী তফুরা বেগমের ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। ময়দানদিঘীতে সরকারি কোন খাস জমি নাই, যেখানে তাকে কিছু করে দেওয়া যায়। আশ্রয়নের যে ঘরগুলো ময়দানদিঘীতে আছে সেগুলো ফাকা নেই। ময়দানদিঘী ইউনিয়নের আশেপাশে ইউনিয়নগুলোতে কোন ফাকা ঘর থাকলে সেখানে তাদের যাওয়ার সুযোগ আছে। আর যদি তিনি ওইখানেই থাকতে চায় সেক্ষেত্রে কোন বৃত্তবান ব্যক্তি তাকে জায়গা দেন তাহলে আমরা টিন দিয়ে ঘর করে দিতে পারি।