প্রায় ৩২ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর শনিবার সকাল ও সন্ধ্যায় আরও তিন দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। একটি নরসিংদীর পলাশে এবং দুটি ঢাকার বাড্ডায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ধারাবাহিক মৃদু ভূমিকম্প ‘আফটারশক’ হলেও এগুলো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বা ‘ফোরশক’ হওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে।
তাদের মতে, ভূগর্ভে বড় ধরনের শক্তি জমা হলে তা সাধারণত সাবডাকশন জোনে গিয়ে মুক্তি পায়। ঢাকার অবস্থান এমন একটি জোনের বিপজ্জনকভাবে কাছে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন ভূতাত্ত্বিক ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনক্ষম ভবন নির্মাণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মিত ভবন দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সম্ভাব্য বিপর্যয় ভয়াবহ হতে পারে।
সাবডাকশন জোনে ঢাকার অবস্থান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া জানান, বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্ব দিকে বার্মিজ সাবপ্লেটের নিচে এবং উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে, যা সাবডাকশন প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচিত। এই দীর্ঘ জোন সিলেট থেকে টেকনাফ, সেখান থেকে জাভা-সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত।
তিনি বলেন, ঢাকার উত্তর-পূর্বে ডাউকি ফল্ট ও মধুপুরের উপকণ্ঠেও সক্রিয় ফল্ট রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেও এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হওয়ার নজির আছে। অর্থাৎ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাস্তব ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
ছোট ভূমিকম্পগুলো কী ইঙ্গিত দিচ্ছে
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, নরসিংদী ও ঢাকায় পরপর ছোট ভূমিকম্প হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এগুলো বড় ভূমিকম্পের আগে সম্ভাব্য ‘ফোরশক’ হতে পারে। আগামী দুই থেকে তিন দিন এ ধরনের ভূমিকম্প আরও ঘটলে বড় ধরনের কম্পন আসতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি। তার মতে, এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মানসিক চাপ বাড়ছে জনমনে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। শুক্রবারের ভূমিকম্পে অনেকেই এখনও ট্রমায় আছেন। তিনি বলেন, ডাউকি ফল্টে বড় ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ঢাকায়, যদিও কম্পনের কেন্দ্র ঢাকা নাও হতে পারে। তার মতে, একই জোনে ধারাবাহিক ছোট-মাঝারি ভূমিকম্পও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের সার্বিক পরামর্শ
আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য, ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা যাচাই করতে জাতীয় পর্যায়ে দল গঠন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা, প্রশস্ত রাস্তা ও খোলা জায়গা রেখে নগর পরিকল্পনা, নাগরিকদের ভূমিকম্প-প্রস্তুতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সিমুলেশন ড্রিল ইত্যাদি।
দেশে ভূমিকম্প নিয়ে উদ্বেগ বাড়লেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয় নয়, প্রস্তুতিই বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে।