মেহেরপুরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর পরিবারকে শিশুসুরক্ষা ভাতা প্রদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শিশুসুরক্ষা ভাতা কার্যক্রমে বঞ্চিত শিশুদের ভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও মেহেরপুরে এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। জানা গেছে এতিম, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০০৮ সালে “আমাদের শিশু” নামক ১৮ মাসের অর্থ সহায়তা কার্যক্রম হাতে নেয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও এতিম শিশুদের প্রতিপালন বা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের দেখাশোনা করা।
পরবর্তীতে শিশু শ্রম হ্রাস করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রাণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রাণালয় যৌথভাবে কার্যক্রম শুরু করে যাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মধ্য হতে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সুরক্ষা করা যায়। এসকল শিশুদের সুরক্ষায় অর্থসহায়তার লক্ষ্যে চাইল্ড সেনসেটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
শিশুসুরক্ষা ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা থেকে জানা গেছে সুবিধাভোগী শিশুদের মধ্যে রয়েছে শিশু শ্রমে যুক্ত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশু, বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা শিশু, তীব্র মাত্রার মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন অভিভাবকহীন যতœ বঞ্চিত শিশু। যারা ৬-১৮ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে ১৮ মাসে ৩৬ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হবে। শিশুসুরক্ষা ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা আগষ্ট-২০২৩ অনুসরণ করে মেহেরপুর জেলা সমাজসেবার আওতায় তিন উপজেলা ও শহর সমাজসেবা থেকে ৪১.০১.৫৭০০.০০০.০৭.০১১.২১.৫১৭ স্মারকে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত মোট ৩৯ জনের একটি তালিকা প্রেরণ করা হয়। যার মধ্যে ২৩ জন ছেলে ও ১৬ জন মেয়ে। জেলা সমাজসেবার আওতায় তিন উপজেলা ও শহর সমাজসেবা থেকে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত মোট ৩৯ জনের একটি তালিকা এই প্রতিবেদকের হাতে আসে।
তালিকা অনুসারে অনুসন্ধানে দেখা গেছে সুবিধাভোগী একজনও শিশু শ্রমে যুক্ত, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা বা তীব্র মাত্রার মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন শিশু নয়। যারা ভাতা পাচ্ছেন তারা সকলেই সুস্থ-সবল ও উন্নত জীবনযাপন করা শিশু।
মেহেরপুরে তালিকাভুক্ত ৩৯ জনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রেও মানা হয়নি নীতিমালা। নীতিমালা উপেক্ষা করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর পরিবর্তে ভাতা নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, যুব মহিলা লীগ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ ও মহিলা কাউন্সিলর ও প্রভাবশালীদের ছেলে-মেয়েরা। যার ফলে প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা রয়ে গেছে বঞ্চিত।
সুবিধাবঞ্চিতদের জায়গায় সুবিধা নিচ্ছেন মোছাঃ বৃষ্টি খাতুন। তিনি সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের মোঃ ইয়ারুল ইসলামের মেয়ে। তাকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু হিসেবে দেখানো হয়েছে অথচ তিনি বর্তমানে যাদুখালি স্কুল এন্ড কলেজের ইন্টারমেডিয়েট ১ম বর্ষের ছাত্রী। তিনি শিশুসুরক্ষা ভাতা হিসেবে ২২ হাজার টাকা পেয়েছেন। তিনি ০১৭৯৮৯৪০৯৭৩ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। মাইশা ফাহমিদা মাওয়া তিনি মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমান হিরনের মেয়ে। তিনি ০১৭৬০৯৬৯০০১ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। আবু সুফিয়ান শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামাল হোসেনের ছেলে। তিনি ০১৭১৬১৪২০৯৮ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। সিফাত আল ইব্রাহিম তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের সভাপতি তারিকুল ইসলাম রাজীবের ছেলে। তিনি ০১৭০৩৫৪৫৭৫৭ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। মারুফ হোসেন তিনি মুজিবনগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি মতিউর রহমানের ছেলে। তিনি ০১৯৫৯৮৮০৩৮৮ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। মুবাশশিরা হাসান রিজা তিনি পৌর যুব মহিলা লীগের আহবায়ক ও পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর রোকসানা কামাল রুনুর মেয়ে। তিনি ০১৭১০১৭৭৫০৯ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। তামিম তাজ তুর্য তিনি মুজিবনগর উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি তকলিমা খাতুনের ছেলে। তিনি তিনি ০১৯৩৭৫৬২০৫৮ নম্বরে ভাতা নিচ্ছেন। এরা সকলে সুস্থ-সবল হলেও তাদের সকলকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু দেখিয়ে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক কাজী কাদের মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সাথে সক্ষতা গড়ে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও তার অনুসারীদের নানা অনৈতিক সুবিধা দিতেই প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বঞ্চিত করে উপরোক্ত দলীয় নেতার সন্তাদের সুবিধা দিয়েছেন।
এবিষয়ে সহকারি পরিচালক কাজী কাদের মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী বলেন, এবিষয়টি তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে। তালিকা অনুযায়ী বিষয়টি তদন্ত চলছে। যেহেতু বিষয়টি তদন্ত চলছে সেহেতু তদন্ত শেষে আমরা বিষয়টি বলতে পারবো। উল্লেখ্য এর আগেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়। একের পর এক দুর্নীতি করলেও প্রভাব খাটিয়ে তিনি থাকছেন ধরা ছোয়ার বাইরে ও বহাল তবিয়তে।