সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ‘রিল’ ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেই মুহূর্তে আগুনের সূত্রপাত, সেই সময়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভিডিওটি ধারণ করেছেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি ভবনের নিচতলার একপাশে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আগুনের লেলিহান শিখা। তখনও বেইলি রোডে রাতে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। কেউ কেউ রিকশা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ওই আগুন দেখছেন, কেউ আবার রাস্তা পার হয়ে আগুনের দিকেই ছুটছেন। তখনও আগুন নিচতলাতেই ছিল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন দ্রুত ভবনের উপরের দিকে উঠতে থাকে। কীভাবে ভবনটিতে আগুন দ্রুত ছড়ালো, তা উঠে এসেছে প্রাথমিক তদন্তে।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কজি কটেজ’ বহুতল ভবনে দ্রুত ওই আগুন নিচতলা থেকে উপরের দিকে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এসি, গ্যাস সিলিন্ডার আর ভবনের একপাশে কাচের আধিক্য থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে ও ধোঁয়া বের হওয়ার কোনও জায়গা পায়নি বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। এরপর প্রায় টানা দুই ঘণ্টা আগুনে পুরো ভবন জ্বলতে থাকে। এদিকে সারা দিনই এই ভবনে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিদর্শন করেছে। ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব) বলছেন, আগুনটি যেহেতু নিচ থেকে সূত্রপাত হয়েছে, আগুনের ধর্মই উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়া। সে দাহ্য কিছু পেলে, বের হতে না পারলে পুরো ভবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই কোনও বাধা ছাড়া আগুন উপরের দিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, আগুন লাগার সময় ভেতরের লোকজন একটি নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়েছিল। নিচতলায় আগুন লাগায় তারা নামতে না পারায় ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁর বড় একটি কক্ষকে নিরাপদ ভেবে তারা জড়ো হয়েছিল। কক্ষটিতে চারটি এসি ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেই রুমের এসিতেও একসময় আগুন লেগে যায়। এসময় দম বন্ধ হয়ে সেখানে অবস্থান নেওয়া লোকজন মারা যান। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল সূত্রে জানা যায়, ওই কক্ষটিতে বাচ্চা ও বড়দের জুতাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ভবনটির চারতলার রেস্টুরেন্টে অর্ডার করা খাবার টেবিলের ওপর সাজানো ছিল।
শুক্রবার (১ মার্চ) দুপুরে থেকে বিকাল পর্যন্ত বেইলি রোডে সরেজমিন দেখা যায়, তদন্তের স্বার্থে অগ্নিকাণ্ডের ওই ভবনটি ঘিরে রেখেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। চলছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। পুড়ে ছাই হওয়া ভবনটি ঘুরে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত, কীভাবে আগুন ছড়ালো, তা খতিয়ে দেখে তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন তারা।
তবে শুক্রবার র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন ঘটনাস্থলে সংবাদকর্মীদের জানান, ‘নিচতলায় একটা ছোট দোকান ছিল, সেখান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়েছে। এখানে অধিকাংশ যেহেতু রেস্টুরেন্ট ছিল, সেহেতু অনেক গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। সেগুলোতেই আগুন ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে তা-ই ধারণা করা হচ্ছে।’
শুক্রবার সকালে মগবাজার থেকে পরিস্থিতি দেখতে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন রায়হান নামে এক যুবক। আগুন লাগার মুহূর্তেও তিনি ঘটনাস্থলের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বাসায় ফিরছিলাম। পাশের গলি দিয়ে আমি মগবাজারের দিকে বের হবো। হঠাৎ দেখলাম আগুন। খুব বড় না, কিন্তু বেশ লেলিহান। নিচতলায় একটা চায়ের দোকান, সেখানেই আগুনটা লেগেছে। আমি এক দুই মিনিটের মধ্যে স্থান ত্যাগ করি। বাসায় ফিরে রাতে যখন টিভি দেখছি, তখন দেখি পুরো ভবনই শেষ।’
নিচে আগুন লাগার পরে উপরের দিকে না গিয়ে ‘কাচ্চি ভাই’তে কেন অনেকেই গিয়েছিলেন- প্রশ্নে এই ভবন থেকে বেরিয়ে আসা একজন বলেন, ‘আগুন লাগার পর কেউ নামতে পারেননি। কেউ বলছিলেন উপরে আগুন লেগেছে, কেউ বলেছেন নিচে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোন জায়গাটা নিরাপদ। ভবনটিতে একটি সিঁড়ি, লিফট দুটি ছিল।’
শুক্রবার (১ মার্চ) বিকালে পুড়ে যাওয়া ভবনটির প্রতিটি ফ্লোর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘুরে দেখেছেন ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) জেনারেল সেক্রেটারি জাকির উদ্দিন আহমেদ। ভবনটি ঘুরে এসে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনটিতে যে ফায়ার অ্যালার্মিং ও অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা, তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও ছিল না। প্রতিটি ফ্লোরে ওঠার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল সংকুচিত। আর যা ব্যবস্থা ছিল সেটিও ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে নিচ থেকে উপরের দিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ইমারজেন্সি কোনও দরজা ছিল না। সিঁড়ির পাশেই গ্যাস সিলিন্ডার পড়ে থাকতে দেখেছি। এমনকি অগ্নিনির্বাপণের যে যন্ত্রগুলো রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি।’
আজ দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই ভবনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল কিনা, আমরা তদন্তে দেখতে চাই। এছাড়া ভবন নির্মাণ করতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছিল কিনা তাও আমরা তদন্ত করে দেখবো। আমরা তদন্তে দেখতে পাবো কীভাবে আগুন লেগেছে এবং এখানে কারও গাফিলতি ছিল কিনা। তবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল নিচতলা থেকে। আমাদের প্রাথমিকভাবে ধারণা, গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগে। এতে অন্তত ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২২ জন। আগুন নেভানোর পর হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।